‘বুড়ি’ এক হারিয়ে যাওয়া নদী
প্রকাশিত : ০৪:০৭ পূর্বাহ্ণ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার ৩৭০ বার পঠিত
‘সংগ্রামর বাদেও বুড়ি নদী মুখা বড় বড় নৌকা চলতে দেখছি। বাপ-দাদার গেছ থাকি হুনছি ই নদী মুখা (দিয়ে) বড় বড় জাজ (জাহাজ) চলত। কিন্তু অখন অনেক জাগাতই নদীর কোনো চিহ্ন নাই।’ সিলেটের ওসমানীনগরের অস্তিত্বহীন বুড়ি নদী নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বললেন উত্তর মজলিসপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ চাঁন মিয়া।
জানা যায়, প্রাচীন বালাগঞ্জের মানচিত্র ও ইতিহাসে বিলুপ্ত বুড়ি নদীর স্পষ্ট অবস্থান থাকলেও হ্নমানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে নদীটি বিলীন হয়ে গেছে। এক সময়কার বিশাল নদীটি খাল, ডোবা, বসতবাড়ি ও ধানি জমিতে পরিণত হয়েছে। মরে যাওয়া পুরো নদীটিকে গিলে ফেলেছেন এলাকার প্রভাবশালীরা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই নদী সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। বুড়ি নদী সিলেটের পূর্বাঞ্চলীয় হাওর এলাকা থেকে তৎকালীন বালাগঞ্জ উপজেলার উত্তর পূর্ব কোণের দয়ামীরের চিন্তামনি দিয়ে প্রবেশ করে উসমানপুর, বোয়ালজুড়, তাজপুর, গোয়ালা বাজার, বুরুঙ্গা, পশ্চিম পৈলনপুর ও সাদীপুর ইউনিয়ন ছুঁয়ে বর্তমান বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলাকে বিভক্ত করে নবীগঞ্জের দিকে প্রবাহিত ছিল। তৎকালীন বালাগঞ্জ উপজেলায় এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার। শতাধিক বছর আগে বুড়ি নদীর বুক চিরে চলত জাহাজ ও সওদাগরদের নৌকা। একসময় পলি দ্বারা ভরাট এবং মানুষের কারণে নদীটির প্রশস্ততা ক্রমেই কমতে থাকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বুড়ি নদী একটি খালে পরিণত হলেও বড় বড় নৌকা চলতে দেখা যেত বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ১৯৯০ সালেও নদীটির অস্তিত্ব ছিল এবং নৌকাও চলত।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ স্থানেই নদীর কোনো চিহ্ন নেই। কিছু কিছু জায়গায় নদীর শেষ চিহ্ন হিসেবে ছিল ছোট খাল। তাজপুর মাছ বাজারের সঙ্গে নদীর শেষ চিহ্ন ছোট খালটি ময়লার ভাগাড় তৈরি করে ভরাট করা হচ্ছে। বছর দু’য়েক পরে এখানেও নদীর শেষচিহ্নটুকু থাকবে না বলে ধারণা করা যায়।
শুধু বুড়ি নদী নয়, ‘রত্না’ নদীসহ অসংখ্য খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। সুরমা নদীর একটি শাখা উপজেলার নাজির বাজার এলাকায় রত্না নাম ধারণ করে দয়ামীর, তাজপুর, গোয়ালাবাজার, উমরপুর হয়ে বানাইয়া হাওরে পতিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রত্না নদীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন যুগলগঞ্জ বাজারে ব্রিটিশবিরোধী কৃষক সম্মেলন হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু নদীটি আজ অস্তিত্বহীন। এ ছাড়া নারকিলাসহ অসংখ্য খালও বিলীন হওয়ার পথে। জলপ্রবাহের পথ প্রায় বন্ধ থাকায় বর্ষায় বন্যাক্রান্ত হয়ে দুর্ভোগ এবং ফসলহানির শিকার হচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবি বিলীন হয়ে যাওয়া নদী ও খালবিলের জায়গা উদ্ধার করে তা খনন করা হলে একদিকে কৃষির ফলন ভালো হবে, অন্যদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার হাত থেকে রক্ষা মিলবে।
দয়ামীর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ‘বালাগঞ্জের মাটি ও মানুষ’ বইয়ের লেখক আবদুল হাই মোশাহিদ বলেন, তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় বুড়ি নদীর অনেক প্রশস্ততা ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এক সময় নদীটি খালে পরিণত হয়। আমরাও বুড়ি নদী দিয়ে নৌকা চলাচল করতে দেখেছি। নদীটিকে গলাটিপে হত্যা করে এর জায়গা দখল করে নেওয়া হয়েছে। ওসমানীনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ময়নুল হক চৌধুরীও ছোটবেলায় বুড়ি নদী দিয়ে নৌকায় চলাচল করার কথা জানালেন। রত্না নামে আরেকটি নদীও অস্তিত্বহীন।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, নদীর জায়গা অবৈধ দখলের একটি তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অস্তিত্ব আছে এমন নদীগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন এবং অস্তিত্বহীন নদীর জায়গা দখলমুক্ত করতে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক সত্যের সন্ধান'কে জানাতে ই-মেইল করুন- sattersandhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক সত্যের সন্ধান'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।